ইয়াবা সম্পর্কে নতুন
করে বলার কিছুই নেই। এ
সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি জানি।
তবে এর পার্শ্ব
প্রতিক্রিয়া কি বা এটি শরীরের ওপর
কি কি ক্ষতিকর প্রভাব
ফেলে সে বিষয়ে অনেকেই
আমরা তেমন কিছুই জানি না।
নেশার এই উপকরণের মূল উপাদান
মিথাইল অ্যামফিটামিন
এবং ক্যাফেইন। ইয়াবাতে ২৫
থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম
মিথঅ্যামফিটামিন এবং ৪৫ থেকে ৬৫
মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। থাই শব্দ
ইয়াবার মূল অর্থ ক্রেজি মেডিসিন
বা পাগলা ওষুধ।
এছাড়া ইয়াবাকে বিভিন্ন
নামে ডাকা হয়। এর
মধ্যে ক্রেজি মেডিসিন, হিটলারস্
ড্রাগ, সাবু,
বুলবুলিয়া নামগুলো উল্লেখযোগ্য।
ইয়াবার আসল নামের
বাইরে এটি বিক্রির জন্যও
রয়েছে নানা সাংকেতিক নাম।
এরমধ্যে বাবা, সিমকার্ড ও
প্যারাসিটামল প্রধান। এ
ছাড়া বিভিন্ন প্রকার
ইয়াবাকে চম্পা, চম্পা সুপার, আর ৭০, আর
৮০, আর ৯০, জিপি, ঝাকানাকা,
ডাব্লিউ ওয়াই, এনসিআরএস, ডাব্লিউ
এক্স প্রভৃতি নামেও অভিহিত
করে ব্যবহারকারীরা।
মূলত জীবনরক্ষাকারী ঔষধ হিসেবেই
প্রথম ১৯১৯
সালে জাপানিরা ইয়াবা তৈরির
পরিকল্পনা করে। এছাড়া কথিত আছে,
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়
জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলার তার
মেডিকেল চিফকে আদেশ দেন এমন ওষুধ
তৈরির, যেন এটি খেয়ে দীর্ঘ সময়
ধরে যুদ্ধ করলেও
যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের
ক্লান্তি না আসে। হিটলারের
নির্দেশে জার্মান
কেমিস্টরা এটি তৈরি করতে সমর্থ
হয়েছিলেন। তখন এর নাম ছিল
‘পারভিটিন’। একসময়
ট্যাবলেটটি থাইল্যান্ডে প্রকাশ্যে বিক্রি হত।
থাই ট্রাক
চালকেরা রাতে গাড়ি চালানোর
ক্লান্তি ভুলে থাকার জন্য এটা ব্যবহার
করতেন। পরবর্তীতে ইয়াবাসেবী ট্রাক
ও বাস চালকরা বেশ কয়েকটি ভয়াবহ
দুর্ঘটনা ঘটালে থাই সরকার ১৯৭০
সালে এর বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ
করে।
বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব
ঘটে ১৯৯৭ সালে। পরবর্তীতে ২০০০ সাল
থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজারের
টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার
থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। এই
ট্যাবলেটের দাম
তুলনামূলকভাবে বেশি হবার
কারণে প্রথমদিকে প্রধানত
উচ্চবিত্তদের মাঝেই এটি বিস্তার
লাভ করেছিলো। কিন্তু
পরবর্তীতে নতুন নেশার আনন্দ
নিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের
উঠতি বয়সী তরুণ তরুণী, গায়ক গায়িকা,
নায়ক নায়িকারা এ ড্রাগ গ্রহণ
করতে শুরু করে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায়
তিন ধরনের ইয়াবা পাওয়া যায়। এক
শ্রেণির ইয়াবা ট্যাবলেট সবুজ
বা গোলাপী রঙের হয়ে থাকে। এর
ঘ্রাণ অনেকটা বিস্কুটের মত। দ্বিতীয়
ধরনের ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম
তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এটিও
নেশাসৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তৃতীয়
ধরনের ট্যাবলেটি আরও
সস্তা এবং নেশায় আসক্তদের নিকট
এটি ভেজাল হিসেবে পরিচিত।
ইয়াবা সেবনকারীদের মধ্যে প্রচলিত
ধারণা অনুসারে, চিতা নামের
পিলটি সবচেয়ে নিম্নমানের। এর
গায়ে ক্ষুদ্র চিহ্ন থাকে।
অন্যদিকে গোলাপজল নামের
ইয়াবা পিলকে উচ্চমানের পিল
হিসেবে গণ্য করা হয়। ইয়াবা পিলের
গায়ে ইংরেজি ডাব্লিউ ওয়াই
লেখা থাকে। ওয়াই লেখার ধরন দীর্ঘ
হলে এবং ইয়াবার রঙ
পুরোপুরি গোলাপী হলে ধারণা করা হয়
এটি ইয়াবা হিসেবে ভাল মানের।
অন্যদিকে খবরে প্রকাশ, বরিশালসহ
গোটা দক্ষিণাঞ্চলের নেশার
রাজ্যে এখন ইয়াবা ট্যাবলেটের
নামে বিক্রি হচ্ছে জন্মবিরতিকরণ
পিল। বাজার থেকে কম মূল্যের
উচ্চমাত্রার জন্মবিরতিকরণ পিল লাল
রং করে ইয়াবা হিসেবে বিক্রি করছে একটি চক্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক
ইয়াবা গ্রহণকারীরা এ তথ্য
জানিয়েছেন। আর এ নকল
ইয়াবা খেয়ে বন্ধ্যাত্বসহ মৃত্যুর
ঝুঁকিতে পড়ছে ইয়াবা গ্রহণকারী তরুণ-
তরুণীরা।
ইয়াবা খেলে সাময়িক আনন্দ ও
উত্তেজনা হলেও, অনিদ্রা,
খিটখিটে ভাব ও আগ্রাসী প্রবণতা,
ক্ষুধা কমে যাওয়া ও বমি ভাব, ঘাম,
কান-মুখ লাল
হয়ে যাওয়া এবং শারীরিক সঙ্গের
ইচ্ছা বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি লক্ষণ
দেখা যায়। বাড়ে হূৎস্পন্দনের গতি,
রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শরীরের
তাপমাত্রা। মস্তিষ্কের সুক্ষ্ম
রক্তনালীগুলোর
ক্ষতি হতে থাকে এবং কারও কারও
এগুলো ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়।
কিছুদিন পর থেকে ইয়াবাসেবীর হাত
ও পায়ের কাঁপুনি সহ হ্যালুসিনেশন হয়,
পাগলামি ভাব দেখা দেয়।
দীর্ঘদিন
ধরে ইয়াবা খেলে স্মরণশক্তি কমে যায়,
সিদ্ধান্তহীনতা শুরু হয় এবং কারও
কারও ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়ার
লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকে পাগল
হয়ে যায়। ডিপ্রেশন বা হতাশাজনিত
নানা রকম অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়,
এমনকি অনেকে আত্মহত্যাও
করে থাকে। এছাড়া হার্টের
ভেতরে ইনফেকশন হয়ে বা মস্তিষ্কের
রক্তনালী ছিঁড়েও
অনেকে মারা যান। অনেকে রাস্তায়
দুর্ঘটনায় পতিত হন। কেউ কেউ
টানা সাত থেকে ১০ দিন
জেগে থাকেন। ইয়াবার পার্শ্ব-
প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিশিষ্ট
মনোচিকিৎসক ও সাহিত্যিক ডা.
মোহিত কামাল বলেন, নিয়মিত
ইয়াবা সেবনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ,
নিদ্রাহীনতা, খিঁচুনি, মস্তিষ্ক
বিকৃতি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক
হৃদস্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত,
শরীরে কিছু চলাফেরার অস্তিত্ব টের
পাওয়া, অস্বস্তিকর মানসিক অবস্থা,
কিডনি বিকল, চিরস্থায়ী যৌন-
অক্ষমতা, ফুসফুসের প্রদাহসহ
ফুসফুসে টিউমার ও ক্যান্সার
হতে পারে।
এ ছাড়া ইয়াবায় অভ্যস্ততার পর হঠাৎ এর
অভাবে সৃষ্টি হয় হতাশা ও আত্মহত্যার
প্রবণতা। তিনি বলেন, এ মাদক সাধারণ
শান্ত ব্যক্তিটিকেও হিংস্র ও
আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে।
ইয়াবা গ্রহণে হ্যালুসিনেশন ও
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত
হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
হ্যালুসিনেশন
হলে রোগী উল্টোপাল্টা দেখে,
গায়েবি আওয়াজ শোনে। আর
প্যারানয়াতে ভুগলে রোগী ভাবে অনেকেই
তার সঙ্গে শত্রুতা করছে।
তারা মারামারি ও সন্ত্রাস করতেও
পছন্দ করে।
ইয়াবা সেবনে যৌবন ও
জীবনীশক্তি হ্রাস পেতে থাকে।
ইয়াবা সেবনকারীদের দাম্পত্য জীবন
চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে।
ইয়াবা সেবনকারীদের নার্ভ
বা স্নায়ুগুলো দুই থেকে তিন বছরের
মধ্যে অচল হয়ে যায়। যেহেতু
ইয়াবা সেবনকারীরা শারীরিকভাবে অক্ষম
হয়ে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই
তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত
হতে পারে। অস্থিরতার
কারণে তারা যে কোন অঘটন
ঘটাতে পারে। তাই ইয়াবার
প্রতিরোধে সমাজের সচেতন
সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ,
দয়া করে আপনার সন্তানদের
প্রতি যত্নবান হন। টাকা চাওয়া মাত্রই
সন্তানকে টাকা না দিয়ে তাকে সময়
দিন।
বন্ধুর মতো সপ্তাহে একদিন হলেও সময়
দিন। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান
যদি দীর্ঘদিন ইয়াবা আসক্ত হয়ে যায়
তবে প্রচুর টাকা খরচ করেও তার
স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব
নয়। তাকে হয়তো আংশিক সুস্থ
করা যাবে, কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার
সন্তান থাকবে জীবন্ত একটি লাশের
মতো। আপনার তখন কিছুই করার
থাকবে না। তাই আমাদের সবার উচিত,
ইয়াবার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ
গড়ে তুলে আমাদের দেশের যুব
সমাজকে রক্ষা করা।
ইয়াবা বিষধর সাপের থেকেও ভয়ানক
28 Saturday Feb 2015
Posted Uncategorized
in